জমির ১৫ প্রকার দলিল সহজে চেনার উপায়
জমি জমার মালিকানার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হচ্ছে দলিল। কয়েক টাকার কাগজে লেখা এই দলিল কোটি টাকার সম্পত্তির মালিকানা নিশ্চিত করে । দলিলে কোন ভুল থেকে গেলে তার দায় বহন করতে হয় জমি ক্রেতাকে। আমাদের দেশের সাধারন মানুষদের দলিল ও খতিয়ান বিষয়ক জ্ঞান খুবই সীমিত। আর এই জন্য পদে পদে হয়রানি, প্রতারণা ও বে-দখলের স্বীকার হতে দেখা যায়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রকারের দলিলের মাধ্যমে জমি হস্তান্তর বা মালিকানা বদলী হয়ে থাকে । মালিকানা বদলী বা হস্তান্তরের উপর ভিত্তী করে দলিল সম্পাদনের ধরন নির্বাচন করা হয়। আমাদের দেশে সর্বাধিক প্রচলিত দলিলের পরিচিতি ও ব্যাবহার একে একে নিচে বর্ণনা করছি-
১। সাফ-কবলা দলিল
কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তি অন্যের কাছে বিক্রি করার সময় যে দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দেন তাকে সাফ-কবলা অথবা কবলা দলিল বলা হয়। সাফকবলা দলিল নির্ধারিত স্ট্যাম্পে লেখার পর দলিলদাতা অর্থাৎ বিক্রেতা সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে উপস্থিত হয়ে গ্রহীতা অর্থাৎ খরিদ্দারের বরাবরে রেজিস্ট্রি করে দেবেন। এ দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলিলের তফসিলে লিখিত অর্থাৎ বিক্রীত ভূমির যাবতীয় স্বত্ব দলিলদাতা থেকে বিলুপ্ত হয়ে দলিল গ্রহীতা অর্থাৎ খরিদ্দারের ওপর অর্পিত হয়। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী রেজিষ্ট্রীকৃত দলিল সাফকবলা দলিল। আধুনিক দলিলের ফরমেট অনুসারে দলিলের প্রথম পাতায় দলিলের প্রকৃতি অংশে সাফকবলা লিখা থাকায় সহজেই এই দলিল চেনা যায়।
২। বায়নাপত্র দলিল
কোন সম্পত্তি বিক্রয়ের জন্য ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে যে চুক্তিপত্র সম্পাদন করা হয় তাকে বায়নাপত্র বলে। বর্তমানে বায়না দলিল রেজিষ্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। যদি কোন ব্যক্তি বায়নাপত্র মারফত জমির দখল বুঝিয়ে দিয়ে থাকেন এবং মূল্যের টাকা গ্রহণ করে থাকেন এবং বিশেষ কারণে দলিল সম্পাদন ও রেজিষ্ট্রী না করেন তাহলেও সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৫৩ ধারা মতে আংশিক বিক্রয় কার্যকরী হবে। অতএব, জমিতে খরিদ্দারের স্বত্ব হয়েছে বলে গণ্য হবে।
৩। দানপত্র দলিল
যে কোনো সম্প্রদায়ের যে কোনো ব্যক্তি তার সম্পত্তি দান করতে পারেন। এ দানপত্র দলিলে শর্তবিহীনভাবে সকল প্রকার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। স্বত্ব সম্পর্কে দাতার কোনো প্রকার দাবি থাকলে দানপত্র শুদ্ধ হবে না। এছাড়া দানপত্র দলিলের সাথে বাস্তব দখল বুঝিয়ে দেয়া আবশ্যক। কারন দান গ্রহীতা দখল গ্রহণ না করলে দান পরিপূর্ণ হয় না।
৪। হেবা দলিল
দান পত্র দলিল বা হেবা দলিল একই জিনিস। মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য যে দানপত্র দলিল করা হয় তেই হেবা দলিল নামে পরিচিত। এ দলিল কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়, কেবল সন্তুষ্ট হয়ে এ রকম দান করা হয়। কিন্তু এ হেবা শর্তবিহীন অবস্থায় দান বিক্রয়, কট রেহান ও রূপান্তর ইত্যাদি সব ক্ষমতা প্রদানে দান বা হেবা করতে হবে। স্বত্ব সম্পর্কে দাতার কোনোরকম দাবি থাকলে সে দান বা হেবা শুদ্ধ হবে না এবং তা যে কোনো সময় বাতিলযোগ্য। এ রকম দানপত্রে দাতার কোনো স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে না।
৫। হেবা বিল এওয়াজ দলিল
হেবা বিল এওয়াজও মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি দানপত্র দলিল এবং এ দানও সন্তুষ্ট হয়ে করা হয়। কিন্তু হেবা দলিলের সাথে হেবা বিল এওয়াজ দলিলের পার্থক্য হল এটি কোনো কিছুর বিনিময়ে হয়ে থাকে, যেমন- পবিত্র কোরআন, জায়নামাজ, তসবিহ, মোহরানার টাকা, এমনকি যে কোনো জিনিসের বিনিময়েও হতে পারে। হেবা বিল এওয়াজ দলিল সম্পূর্ণ শর্তবিহীন অবস্থায় গ্রহীতা যাবতীয় হস্তান্তর ও রূপান্তরের সকল প্রকার ক্ষমতার অধিকারী হবেন এবং দাতার যাবতীয় স্বত্ব গ্রহীতার কাছে অর্পিত হবে। হেবা বিল এওয়াজ অবশ্যই রেজিস্ট্রিকৃত হতে হবে। হেবা বিল এওয়াজ যদি টাকার বিনিময়ে হয় এবং ক্রমিক ওয়ারিশিসূত্রে আগে পরে তিন ধাপের পরের ব্যক্তিকে বা তৃতীয় ব্যক্তিকে হেবা বিল এওয়াজমূলে দান করে থাকে তাহলে শরিক কর্তৃক জানার তারিখ থেকে চার মাসের মধ্যে প্রিয়েমশান বা অগ্রক্রয় করতে পারে।
মামলা থাকলে কি চাকরী হয়?
৬। এওয়াজ বদল দলিল
যে কোন সম্প্রদায়ের কোন ব্যক্তি যে কোন ব্যক্তির সহিত নিজেদের সুবিধা মত একের ভূমি অপরের সহিদ বদল করতে পারেন অর্থাৎ পরস্পর এওয়াজ পরিবর্তন করতে পারেন। যেমন, করিমের বাড়ির পাশে রহিমের একটি জমি আছে এবং রহিমের বাড়ির পাশে করিমের একটি জমি আছে। করিম ও রহিম তাদের সুবিধা মত ব্যাবহারের জন্য উভয়ের জমি এওয়াজ বদল করে নিতে পারবে। তবে, এই দলিল অবশ্যই রেজিষ্ট্রী করতে হবে। এওয়াজ বদল দলিলে কে্ও প্রিয়েমশান করতে পারে না।
৭। বণ্টন নামা দলিল
শরিকরা নিজ নিজ ছাহামপ্রাপ্ত হয়ে ওই ছাহামের বাবদ যে দলিল করে থাকে, তাকে বণ্টননামা দলিল বলে। একই সম্পত্তিতে মালিক হয়েছেন এ রকম মালিক কে সাধারণত শরিক বলা হয়। শরিক দুই প্রকারের। যথা- উত্তরাধিকারসূত্রে শরিক ও কোনো শরিক থেকে খরিদসূত্রে শরিক। ইংরেজিতে বলা হয় কো-শেয়ারার বাই ইনহেরিট্যান্স অ্যান্ড কো-শেয়ারার বাই পারচেজ।
বণ্টননামা দলিল করার সময় সব শরিক দলিলে পক্ষভুক্ত থেকে ও দস্তখত করে বণ্টননামা দলিল করতে হবে। কোনো একজন শরিক বাদ থাকলে বণ্টননামা শুদ্ধ হবে না। । যদি শরিকরা আপসমতে বণ্টন করতে রাজি না হন তাহলে যে কোনো শরিক বণ্টনের জন্য আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন।
৮। অসিয়তনামা দলিল
অসিয়ত দলিল একধরনের দানপত্র। দাতার মৃত্যুর পর এ দলিল কারযকর হয়। এ দলিলের মাধ্যমে কোন নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে দাতা তার মোট সম্পত্তির তিন ভাগের একভাগ অসিয়ত করতে পারবেন। দাতা মারা যাবার পর দাতার সকল পাওনা ও সৎকার খরচ বাদ দিয়ে যে সম্পত্তি থাকবে তার তিন ভাগের এক ভাগ অসিয়ত গ্রহীতা মালিক হবে এবং অবশিষ্ট দুই তৃতীয়াংশের মালিক উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সবাই হবেন।
আমাদের সেবা গুলো যাচাই করুন
৯। উইল দলিল
মুসলমানদের অসিয়তনামা দলিল এবং হিন্দুদের উইলনামা দলিল মূলত একই জিনিস। তবে, হিন্দুদের উইলে সম্পত্তির কোন পরিমাণগত সীমাবদ্ধতা নেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক তাদের নিজস্ব সম্পত্তি তাদের আত্মীয়দের মধ্যে যাকে ইচ্ছা উইল করে দিতে পারেন। যিনি উইল করলেন তিনি জীবদ্দশায় একের অধিক উইল করতে পারেন। কিন্তু সর্বশেষ যে উইল করলেন কেবল সেটাই কার্যকর হবে।
১০। না-দাবী দলিল
কোনো ব্যক্তি সুনির্দিষ্ট কোনো সম্পত্তিতে তার স্বত্বাধিকার নেই মর্মে অথবা স্বত্বাধিকার ত্যাগ করেছেন মর্মে দলিল সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করে দিতে পারেন। এ রকম দলিলকেই না-দাবি দলিল বলা হয়। ওয়ারিশান সম্পত্তির ক্ষেত্রে কোন ওয়ারিশ তার হিস্যা ছেড়ে দিলে না-দাবী দলিলের মাধ্যমে স্বত্তত্যাগ করে।
১১। বয়নামা দলিল
খাজনা বকেয়া বা সরকারী স্বার্থে কোন সম্পত্তি নিলাম বিক্রয়ের পর যিনি নিলাম খরিদ করেন তাকে একটি নিদর্শনপত্র বা সার্টিফিকেট দেয়া হয়। খরিদ্দারকে প্রদত্ত এই সার্টিফিকেট বয়নামা নামে সাধারন মহলে পরিচিত। এই সার্টিফিকেট আদালত প্রদান করে থাকে।
১২। দখলনামা দলিল
বণ্টনের মোকদ্দমা, স্বত্ব সাব্যস্তপূর্বক খাস দখল, উৎপাত ও অগ্রক্রয় (প্রিয়েমশান) ইত্যাদি মোকদ্দমায় ডিক্রির পর আদালত যে দখলি পরোয়ানা দাখিল করেন। তাকে দখলনামা দলিল বলা হয়।
১৩। রায়-ডিক্রি দলিল
কোনো সম্পত্তি, টাকা-পয়সা কিংবা অন্যান্য যে কোনো কারণে আদালতে মামলা হলে আদালত লিখিতভাবে যে রায় এবং ডিক্রী প্রদান করেন তাকে সাধারনত রায়-ডিক্রী দলিল বলা হয়।
১৪। বেনামী দলিল
কোন ব্যক্তি বিশেষ কোন কারণে তার নিজের নামে সম্পত্তি খরিদ করতে অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া বিবেচিত হলে ঐ ব্যক্তি নিজ অর্থে ও স্বার্থে সম্পত্তি খরিদ করে তার দলিল নিজের নামে না করে তার যে কোন আত্মীয়ের বা বিশ্বাসী বন্ধু বান্ধবের নামে বেনামী দলিল করতে পারেন বা নিজের সম্পত্তি ঋণের দায়ে বা অন্য কোন কারণে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ঐ ব্যক্তি তার নিজের সম্পত্তি কোন আত্মীয় স্বজনেবা বন্ধু বান্ধবের নামে দলিল করে দিতে পারেন। যদিও এসব দলিল সাফকবলা বা হেবা করা হয় তবুও সবাই এটাকে বেনামী দলিল বলে ডাকে।
১৫। কোর্ট সাফকবলা দলিল
কোন ব্যক্তি তার সম্পত্তি বিক্রয় করার জন্য কারোও নিকট হতে বায়না বাবদ টাকা গ্রহণ করে বায়নাপত্র সম্পাদন করে দিয়ে যদি দলিল সম্পাদন ও রেজিষ্টারী করে না দেয় তাহলে যে ব্যক্তি বায়না দিয়েছেন তিনি আদালতযোগে নালিশ করে আদালত কর্তৃক দলিল সম্পাদন ও রেজিষ্টারী করিয়ে নিতে পারেন। এ রকম দলিল আমাদের সমাজে কোর্ট কবলা নামে অধিক পরিচিত।
আমাদের পরামর্শ বা সেবা নিতে – ক্লিক করুন
আইন বিশারদ