বিদেশ থেকে তালাক দেয়া যাবে ?
আমাদের কাছে অনেকেই প্রশ্ন করেন, বিদেশ তালাক দেওয়া যাবে কিনা? আর তালাক দিলেই বা সেটা হবে আইনসিদ্ধ হবে কিনা? অথবা বিদেশ থেকে তালাক দেওয়ার আইনসিদ্ধ পদ্ধতি কি? এসব বিষয়ে জানতে চান। আজকের পোস্টে আমরা এ সমস্ত বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা করব।
আল্লাহ পাক স্বয়ং তালাককে অপছন্দ করেন যদিও তা হালাল এবং জায়েজ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তালাকের অন্যতম কারণ হচ্ছে ধৈর্য্য এবং সহ্যের সর্বশেষ সীমা অতিক্রম করে যাওয়া অথবা বিবেক বহির্ভূত কোন ঘটনার উত্থান তা স্বামী বা স্ত্রী যেকোন পক্ষ থেকে হোক।
এছাড়াও তালাকের পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্দন ও স্বামী-স্ত্রীর যোগাযোগের দূরত্ব, অতিরিক্ত জেদ, অহামিকা ইত্যাদি বিষয় প্রত্যক্ষ ভাবে দায়ী থাকে। প্রবাসে থাকা স্বামী/স্ত্রীর মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদের কারন হিসাবে আমরা কর্ম অভিজ্ঞতায় নিম্ম বর্ণিত কারনগুলো লক্ষ্য করেছি।
(ক) পরস্পরের সহিত যোগাযোগ ও সানিধ্যতার ঘাটতি।
(খ) আল্লাহ ভীরুতা এবং ধর্মপরায়ণতার অভাব।
(গ) জীবন সঙ্গীর অবমূল্যয়ন করা।
(ঘ) এক বিলাসিতায় আসক্ত হওয়া এবং অন্য পক্ষ সে চাহিদা পূরনে অক্ষম হওয়া।
(ঙ) সব সময় সন্দেহের চোখে রাখা এবং তা সরাসরি অবজ্ঞার স্বরে স্ত্রীকে বা স্বামীকে বলা।
(চ) পরিবারের কারো কথায় প্রভাবিত হওয়া।
(ছ) আত্মনিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা ও পর পুরুষ/ পর নারীতে আসক্ত হয়ে যাওয়া।
(জ) কম বয়সের মেয়েদের বিয়ে করা এবং বিয়ের পরবর্তীতে পর্যাপ্ত সময়, ভালবাসা, শারিরীক সংস্পর্শ হতে বঞ্চিত করে দীর্ঘ সময় দূরে থাকা।
উপরে উল্লেখিত কারণ ছাড়াও আরো বিভিন্ন কারণে প্রবাস হতে তালাক প্রদানের আবশ্যকতা তৈরি হতে পারে।
একান্ত জরুরী প্রয়োজনে বিদেশ থেকে তালাক প্রদান করার প্রয়োজন হলে আইনসিদ্ধ উপায়ে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে অবস্থানরত প্রতিনিধিকে আম-মোক্তারনামার মাধ্যমে তালাক দেয়ার প্রচলন আছে।
বিদেশ হতে তালাক প্রদানের পদ্ধতি
বিদেশ থেকে তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এম্বাসীর মাধ্যমে বিশেষ পাওয়ার অফ এটর্নি দলিল সম্পাদন করতে হবে। বিশেষ পাওয়ার অব এটর্নী দলিলের মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থানরত কোন ব্যক্তিকে প্রতিনিধি নিয়োগ করা যাবে তার পক্ষে তালাকনামায় সহি স্বাক্ষর এবং তালাক কার্যকরী করার যাবতীয় কার্যক্রম করার জন্য। সে ক্ষেত্রে যা যা করতে হবে তা নিন্মে বর্ণনা করা হলো-
১। আমমোক্তারনামা দলিল মুসাবিদাকরণ এবং বিদেশে প্রেরণ
তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পনের জন্য বিদেশে অবস্থানরত পাওয়ারদাতা বরাবরে আমমোক্তার দলিলের মুসাবিদা পাওয়ার অব এ্যটর্নী আইন-২০১২ এর নির্ধারিত শর্ত মোতাবেক এবং নিদির্ষ্ট ফরমেটে ড্রাফট করতে হবে। দলিলে উভয়ের সুনির্দিষ্ট বিররণ ও পরিচিতি যেমন, এনআইডি তথ্য, ছবি, দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক এবং সুনির্দিষ্ট কাজের তালিকা উল্লেখ থাকতে হবে।
২। বিদেশে দলিল প্রেরণ:
বিশেষ পাওয়ার অব অ্যটর্নী দলিলটি প্রস্তুত করার পর তা কাটিজ পেপারে এ প্রিন্ট করতে হবে এবং গ্রহীতার স্বাক্ষর সহ বিদেশে পাঠাতে হবে। যদিও কিছু দেশের এম্বাসি স্ট্যম্প পেপারে ছাপা দলিল ও প্রত্যয়ন করে থাকে তবুও কার্টিজে প্রিন্ট করাই উত্তম। প্রিন্ট কপি কুরিয়ারে বিদেশে পাঠাতে হবে।
এছাড়া দলিলের সফট কপি পিডিএফ আকারে ইমেল করলে বিদেশ থেকে সেটি সাদা লিগাল সাইজ কাগজে প্রিন্ট করে নিলেও হবে। ইমেইলে দলিল প্রেরণ করলে গ্রহীতার স্বাক্ষর ব্যাতিরেকে পাঠাতে হবে এবং দেশে দলিল ফেরত আসলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যয়ন স্বাপেক্ষে গ্রহীতার স্বাক্ষর নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে।
৩। এম্বাসীতে দলিল দাখিল
বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের সকল এম্বাসী অনলাইনে পূর্ব অ্যপয়েন্টমেন্ট গ্রহণ করে দলিল সত্যায়নের জন্য গ্রহণ করে। অ্যপয়েন্টমেন্ট এর তারিখে বিবাহ সংক্রান্ত প্রমাণাধী যেমন, ম্যারিজ সার্টিফিকেট বা কাবিননামা এবং আমমোক্তার গ্রহীতার ভোটার আইডি/পাসপোর্ট সহ উপস্থিত হতে হবে। সত্যায়ন সমাপ্ত হলে একসেট ফটোকপি এম্বাসীতে জমা দিতে হবে এবং দলিলের মূল কপি কুরিয়ার সার্ভিস এর মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠাতে হবে।
৪। পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ল হতে ভেরিফিকেশন
আমমোক্তার দলিলের মূল কপি দেশে আসার পর তাহা সত্যায়নের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ল দাখিল করতে হবে। এম্বাসী কর্তৃক সত্যয়নের ৬০ দিনের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ল এর দাখিল করতে হয়।
৫। ডিসি অফিস হতে আঠালো স্ট্যম্প সংযুক্ত করণ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ল হতে সত্যয়ন সম্পন্ন হওয়ার ১ মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ডিসি অফিসে স্ট্যম্প সংযুক্ত করণের জন্য সাবমিট করতে হবে। বর্তমান স্ট্যম্প ফির নির্ধারিত পরিমাণ ২০০০/- (দুই হাজার টাকা) যা চালানের মাধ্যমে ব্যংকে জমা করতে হয়। ব্যংকে টাকা দাখিল স্বাপেক্ষে ট্রেজারী অফিসার কর্তৃক মূল আমমোক্তারনামা দলিলে আঠালো স্ট্যম্প সংযুক্ত করে তা দলিল গ্রহীতাকে ফেরত প্রদান করেন।
৬। তালাকের নোটিশ জারী এবং রেজিস্ট্রী
যথাযথভাবে বিশেষ পাওয়ার অব এটর্নী সম্পাদনের পর পাওয়ার গ্রহীতা কর্তৃক পাওয়ার গ্রহীতার ন্যায় একই পদ্ধতিতে তালাকের নোটিশ প্রদান ও রেজিস্ট্রীর সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করিতে পারিবেন।
আম-মোক্তার নামার মাধ্যমে তালাক প্রদানের সীমাদ্ধতা
বিদেশ থেকে আম-মোক্তার নামা দলিলের মাধ্যমে প্রতিনিধি নিযুক্ত করে তালাক প্রদানের যথাযর্থতা সম্পর্কে আইনে সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য নেই। প্রচলিত প্রাকটিস এবং আইনজীবীদের পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই আম-মোক্তারনামা মূলে তালাকের একটা প্রচলন আছে।
তবে এ ধরনের তালাক বহুল বিতর্কীত কারন তালাক সংশ্লিস্ট আইনের কিছু বিধান প্রকৃত অর্থে চর্চা করার সুযোগ থাকেনা। যেমন, তালাক নোটিশ প্রদানের পর সালিশী পরিষদ কর্তৃক উভয় পক্ষকে ডাকানো এবং আপোস মিমাংসার বিষয়টি এক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকে। যেহেতু, তালাক দাতা বিদেশে থাকে কাজেই তাহার পক্ষে আপোষে স্বীয় মতামত প্রদানের সুয়োগ থাকেনা ফলে একপক্ষের কথা শুনে সালিশী পরিষেদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
আবার তালাক নোটিশ প্রদানের পর তালাক দাতা যদি মনে করেন তিনি তালাক প্রত্যাহার করবেন তবুও তাহার প্রতিনিধি আম-মোক্তার যদি তালাক প্রত্যাহারে মত না দেয় সেক্ষেত্রে তালাক কাযর্কর হয়ে যায়। আমার তালাক দাতা যদি মনের করেন আমমোক্তার প্রতাহার করে তালাক বাতিল করবেন তারও সুযোগ থাকেনা যেহেতু ৯০ দিন পর তালাক অটো কাযর্কর হয়ে যায় এবং আমমোক্তার প্রত্যাহার সময় স্বাপেক্ষ্য।
অন্যদিকে, কাজী কর্তৃক তালাক রেজিস্ট্রীকালে কাজীর নির্ধারিত ভলিউমে তালাক দাতার স্বাক্ষর/টিপসই আবশ্যক। আম-মোক্তার নামার মাধ্যমে তালাক প্রদান করলে কাজীর ভলিউমে দাতার সরাসরি সহি-স্বাক্ষর করার সুয়োগ না থাকায় ভবিষ্যতে বিভিন্ন ভাবে জটিলতা সৃষ্টি হয় ।
বিদেশ হতে তালাক প্রদানের পূর্বে যেসব বিষয় জানতে হবে
১। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সত্যয়ন করবে কিনা?
জেলা ভেদে সত্যয়ন ও স্ট্যম্প সংযুক্ত করণের বিভিন্ন নিয়ম-নীতির পার্থক্য দেখা যায়। তালাকের আমমোক্তারনামা বিদেশে প্রদানের আগে আপনার স্থানীয় ডিসি অফিস এবং তালাক রেজিস্টার এর সহিত কথা বলে নিশ্চিত হোন যে বিদেশ থেকে তালাকের আমমোক্তার নামা গ্রহণ করবে কিনা।
২। যেকোন এক পক্ষের মাধ্যমে তালাক প্রদান
যদি এমন হয় যে, স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষ তালাকে সম্মত আছে তাহলে দেশে যে থাকবে তার মাধ্যেমে তালাক প্রদান করাই ভাল এতে অর্থ ও সময় দুটোই বাচঁবে।