দেনমোহর আদায় করবেন কিভাবে?
আমাদের সমাজে দেখা যায় বিয়েতে দেনমোহর নগদ পরিশোধের ব্যাপারটি সরাসরি উপেক্ষা করা হয়। হাতে গোনা কয়েকটা বিয়ে ছাড়া নগদ দেনমোহর আদায় এর উদাহরন খুব কম। অনেকে আবার দেনমোহর দেয়া দূরের কথা বিয়েতে দেয়া বিভিন্ন উপহার কে উসূল দেখিয়ে দেনমোহরের সাথে স্বমন্বয় করে নেয়। বিয়ের পর বক্রী দোনমোহরের অর্থ নিজ তাগিদে কোন স্বামী পরিশোধ করেন না ফলে স্ত্রী তাহার দেনমোহরের পাওনা হতে আজীবন বঞ্চিত থাকেন।

দেনমোহর কেন আদায় করা জরুরী ?
বৈধ মুসলিম বিয়ের অন্যতম শর্ত দেনমোহর আদায় করা। স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর দেনমোহরের অধিকার কে কোন ভাবে অস্বীকার করতে পারেনা। দেনমোহর এর পাওনা পরিশোধ করা স্বামীর জন্য ফরয। বিয়ের সময় যদি দেনমোহার নির্ধারণ করা না হয়ে থাকে অথবা স্ত্রী যদি দেনমোহরের দাবী উত্থাপন না করে তবুও স্বামীর উপর দেনমোহর আদায় করা ফরয। স্ত্রী দেনমোহরের অপরিশোধিত অংশ যেকোন সময় দাবী করতে পারে এবং স্বামী কোন ভাবেই এই দায় এড়াতে পারে না।
দেনমোহর কখন দিতে হবে?
যেসব বিশেষ পরিস্থীতিতে একজন স্ত্রী দেনমোহর এর দাবী আদায়ের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন তা হল-
১। স্বামী দেনমোহর বাকী রেখে মৃতুবরণ করলে
২। দাম্পত্য চলমান অবস্থায় স্ত্রী দেনমোহর এর হক আদায় করতে চাইলে
৩। স্ত্রীকে তালাক প্রদান করলে
৪। স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া স্বামী অন্যত্র বিবাহ করলে
বিস্তারিত জানতে পড়ুন – দেনমোহর কখন দিতে হবে?
স্ত্রী যদি স্বামীকে তালাক দিলে দেনমোহর পাবে কি?
আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা এই যে, স্ত্রী যদি তালাক দেয় তাহলে দেনমোহর এর টাকা পাবেনা। এটি একটি ভূল ধারনা। তালাক যে কোন পক্ষ প্রদান করুক, স্ত্রীর দেনমোহর এর অধিকার কখনো নষ্ট হয়না। ইসলামে স্ত্রীর দেনমোহরের গুরুত্ব দিয়ে বিধান করা হয়েছে যে, স্বামী যদি মারা যায় তার সম্পত্তি হতে স্ত্রীর দেনমোহর এর টাকা পরিশোধের পর বক্রী সম্পত্তি ওয়ারিশদের মধ্যে বন্টন করতে হবে।
কিভাবে দেনমোহর আদায় এর আবেদন করবেন ?
দেনমোহর এর টাকা আদায়ের আবেদন কে অনেকেই দেনমোহর এর মামলা বলে। দেনমোহর এর মামলা – এই শব্দটা শুনলে অনেকেই গাবড়ে যায় এই ভেবে যে মামলা করতে অনেক ঝামেলা, টাকা খরচ, মানুষ কি বলবে এইসব। কেবল এ ভূল ধারণার কারনে বেশিরভাগ স্বাবলম্বী নারীরা তাদের পাওনা টাকা অর্থাৎ দেনমোহর এর অধিকার ছেড়ে দেয়।
প্রকৃতপক্ষে, দেনমোহর আদায়ের জন্য কোর্টে যে আবেদন করা হয় তাকে মামলার সহিত তুলনা করা উচিত নয়। তালাকের পর বা দাম্পত্য চলা অবস্থায় স্ত্রী যদি তার দেনমোহরের টাকা আদায় করতে চায় তাহলে সে স্বামীর কাছে প্রথমে দাবী করবে। স্বামী যদি দেনমোহর পরিশোধে বিলম্ব করে বা অস্বীকার করে সেক্ষেত্রে স্ত্রী আদালতের কাছে আবেদন করবে।
আদালতে আবেদনের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা, কোর্ট ফি দাখিল এবং আর্জি প্রস্তুুত করণ একটি জটিল কাজ কাজেই, একজন আইনজীবীর সহায়তায় এই আবেদন দাখিল করতে হয়। আইনজীবী বাদী/আবেদন কারীর প্রার্থনা অনুযায়ী আর্জি তৈরি করেন এবং তাতে কোর্ট ফি সংযুক্ত করে দালিলিক প্রমানাধী সহ আদালতের নিকট জমা দেন। আদালত আবেদন বিবেচনা করে স্বামী/বিবাদীকে নোটিশ করেন এবং উভয়পক্ষের বক্তব্য শ্রবণ পূর্বক দেনমোহরের অপরিশোধিত অংশ একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদনকারীকে প্রদানের জন্য নির্দে শনা প্রদান করেন।
দেনমোহর এর মামলা করতে কি কি কাগজ প্রয়োজন?
আদালতে দেনমোহর এর আবেদন করতে হলে আবেদনকারীর কিছু কাগজপত্র প্রমাণক হিসাবে দাখিল করতে হয়। যেমন,
১। আবেদনকারীর জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন অথবা পাসর্পোট এর কপি ইত্যাদি।
২। আবেদনকারীর বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা
৩।বিয়ের কাবিননামা অথবা ম্যারিজ সার্টফিকেট
৪। তালাক হয়ে থাকলে তালাকের নোটিশ ও সার্টিফিকেট
৫। স্বামী দেনমোহর প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করছেন এমন কোন ডকুমেন্টস (যদি থাকে)
৬। স্বামী/বিবাদীর জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন অথবা পাসর্পোট এর কপি
৭। স্বামী/বিবাদীর বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা
এছাড়াও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অন্যন কাগজপত্র প্রয়োজন হতে পারে।
স্বামী মারা গেলে দেনমোহর আদায় করা যাবে?
স্বামী মারা গেলে স্ত্রী কর্তৃক দেনমোহর আদায় এর দাবী উত্থাপন করার উদাহরণ খুবই নগন্য। তবে, স্বামী মারা গেলেও স্ত্রী তার দেনমোহর এর পাওনা আদায় করতে পারবে। স্বামীর রেখে যাওয়া নগদ অর্থ , দামী জিনিসপত্র বা জমি-জমা বিক্রয় করে স্বামীর পক্ষে তাহার আত্বীয় স্বজনরা স্ত্রীর দেনমোহর আদায় করবেন। এ বিষয়ে মহামাণ্য হাইকোর্ট ডিভিশান বিগত ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর একটি যুগান্তকারী রায় প্রচার করেন।
রায়ে বলা হয়,
স্বামী অথবা তার পক্ষে যে কেউ (যেমন- বাবা, ভাই বা অন্যকোন আত্মীয়) স্বামীর অপরিশোধিত দেনমোহর আদায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। স্ত্রী প্রয়োজনে দেনমোহর আদায়ের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করে দেনমোহর এর দাবী করতে পারবে। স্বামীর রেখে যাওয়া নগদ অর্থ , মূল্যবান সম্পতি, জমি জমা হতে মোহরানার অর্থ পুণঃরুদ্ধার করতে পারবে।
রায়টি পড়ুন : জিয়াউল হক ও অন্যান্য বনাম ফারহানা ফেরদৌসী ও অন্যান্য
